ইসলামে রোজা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রমজান মাসে প্রতিটি সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিমের উপর রোজা রাখা ফরজ। তবে কিছু কারণে রোজা ভেঙ্গে যেতে পারে বা মাকরুহ হতে পারে। এই কারণগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা থাকা জরুরি, যাতে রোজাদার ব্যক্তি সতর্ক থাকতে পারেন।
রোজা ভঙ্গের কারণসমূহ
রোজা ভঙ্গের কারণগুলোকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
যা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়: এই কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পানাহার, স্ত্রী সহবাস, ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা ইত্যাদি।
যা অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায়: যেমন – ভুলক্রমে কিছু খেয়ে ফেলা অথবা পান করা।
ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভঙ্গের কারণ
- খাবার গ্রহণ: কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু খায় বা পান করে, তাহলে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে। রোজার কথা স্মরণ থাকা অবস্থায় কোনো কিছু গলাধঃকরণ করলে রোজা থাকবে না।
- স্ত্রী সহবাস: রোজার সময় স্ত্রী সহবাস করলে রোজা ভেঙ্গে যায় এবং এর জন্য কাফফারা দিতে হয়। কাফফারা হলো একটানা ৬০ দিন রোজা রাখা অথবা ৬০ জন দরিদ্রকে খাবার দেওয়া।
- ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করা: যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করে, তাহলে তার রোজা ভেঙ্গে যাবে। তবে অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে রোজা ভাঙবে না।
- ইনজেকশন বা স্যালাইন গ্রহণ: পুষ্টিকর ইনজেকশন বা স্যালাইন গ্রহণ করলে রোজা ভেঙ্গে যায়, কারণ এগুলো খাবারের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। তবে জীবন রক্ষাকারী ইনজেকশন যেমন – অ্যান্টিবায়োটিক নিলে রোজা ভাঙে না।
- ধূমপান করা: ধূমপান করলে রোজা ভেঙ্গে যায়, কারণ এর মাধ্যমে শরীরে ধোঁয়া প্রবেশ করে।
অন্যান্য পোস্ট গুলা পড়ূনঃ
অনিচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভঙ্গের কারণ
- ভুলক্রমে পানাহার: যদি কেউ রোজার কথা ভুলে গিয়ে কিছু খেয়ে ফেলে বা পান করে, তাহলে তার রোজা ভাঙবে না। তবে মনে হওয়া মাত্রই তাকে পানাহার থেকে বিরত থাকতে হবে।
- অনিচ্ছাকৃত বমি: অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে রোজা ভাঙে না।
স্বপ্নদোষ কি রোজা ভঙ্গের কারণ?
স্বপ্নদোষ একটি স্বাভাবিক শারীরিক প্রক্রিয়া। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নদোষ হলে রোজা ভাঙে না। এটি অনিচ্ছাকৃত হওয়ায় রোজার উপর কোনো প্রভাব ফেলে না। তবে, স্বপ্নদোষের পর দ্রুত গোসল করে নেয়া উচিত।হাদিসে আছে, “তিনটি কাজের দ্বারা রোজার কোন ক্ষতি হয় না – ভুলক্রমে কিছু খেয়ে ফেললে, অনিচ্ছাকৃত বমি হলে এবং স্বপ্নদোষ হলে।” (তিরমিযী, হা/৭৩০)
রোজা ভঙ্গের কারণ: হাদিসের আলোকে
হাদিসে রোজা ভঙ্গের বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য হাদিস নিচে উল্লেখ করা হলো:
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি রোজা অবস্থায় ভুলক্রমে কিছু খায় বা পান করে, সে যেন তার রোজা পূর্ণ করে। কেননা আল্লাহই তাকে খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন।” (বুখারী, হা/১৮৩১)
অন্য একটি হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রোজা ভাঙে, সে যেন আল্লাহর কাছে তওবা করে এবং এর কাফফারা আদায় করে।”
মেয়েদের রোজা ভঙ্গের কারণ
মেয়েদের ক্ষেত্রে রোজা ভঙ্গের কিছু বিশেষ কারণ রয়েছে, যা পুরুষদের থেকে ভিন্ন। এগুলো হলো:
মাসিক (Menstruation): নারীদের মাসিক শুরু হলে রোজা ভেঙ্গে যায়। এই অবস্থায় রোজা রাখা হারাম। তবে পরবর্তীতে কাজা করে দিতে হয়।
প্রসবোত্তর রক্তস্রাব (Postpartum bleeding): সন্তান জন্মদানের পর নারীদের যে রক্তস্রাব হয়, সেই অবস্থায় রোজা রাখা যায় না। এটিও পরবর্তীতে কাজা করতে হয়।
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়ের রোজা: গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মা যদি রোজা রাখার কারণে নিজের বা সন্তানের স্বাস্থ্যের ক্ষতির আশঙ্কা করেন, তবে তাদের জন্য রোজা না রাখার অনুমতি আছে। তবে পরবর্তীতে এই রোজাগুলো কাজা করে দিতে হয়।
মহিলাদের জন্য রোজার কিছু মাসআলা
মাসিক শুরু হলে রোজা ভেঙ্গে যাবে এবং নামাজও পড়া যাবে না।
মাসিক শেষ হওয়ার পর গোসল করে পবিত্র হয়ে রোজা রাখতে হবে এবং নামাজ আদায় করতে হবে।
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের জন্য রোজা রাখা বাধ্যতামূলক নয়, তবে সুস্থ থাকলে রোজা রাখাই উত্তম।
নফল রোজা ভঙ্গের কারণ
নফল রোজা শুরু করার পর তা ভেঙ্গে ফেললে কাজা করা ওয়াজিব। নফল রোজা ইচ্ছাকৃতভাবে ভেঙ্গে ফেললে পরবর্তীতে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। তবে, কোনো সঙ্গত কারণে নফল রোজা ভেঙ্গে ফেললে গুনাহ হবে না।
নফল রোজা সংক্রান্ত কিছু নিয়ম
নফল রোজা রাখা ঐচ্ছিক, তবে শুরু করলে তা পূর্ণ করা উত্তম।
শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণে নফল রোজা ভাঙ্গা যেতে পারে।
নফল রোজা ভেঙ্গে গেলে পরবর্তীতে কাজা করা ওয়াজিব।
রোজার তাৎপর্য ও ফজিলত
রোজা শুধু উপবাস নয়, এটি আত্মশুদ্ধির একটি মাধ্যম। রোজার মাধ্যমে মানুষ ধৈর্য, সংযম ও সহানুভূতির শিক্ষা লাভ করে। রোজার ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখে, তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়।” (বুখারী, হা/২০০৮)অন্য এক হাদিসে আছে, “রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ রয়েছে: একটি ইফতারের সময় এবং অন্যটি তার রবের সাথে সাক্ষাতের সময়।”
রোজা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। তাই, রোজার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা জরুরি। এই আর্টিকেলে রোজা ভঙ্গের কারণ, স্বপ্নদোষ, মহিলাদের জন্য রোজা ভঙ্গের কারণ, নফল রোজা ভঙ্গের কারণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি, এই আলোচনা রোজাদারদের জন্য সহায়ক হবে।